ভোকাট্টা ব্লগজিন সংখ্যা ৩


রইলাম প্রতীক্ষায়

                 প্রতীক মহাপাত্র

  মৌলালি যুবকেন্দ্রের মঞ্চের মৃদু আলো তখনও নেভেনি। সৌজন্য বিনিময় করে বেরিয়ে এলাম হল থেকে। সাড়ে আটটার ট্রেনে বাড়ি ফিরতে হবে। সময়টা ২০১৭-র জুনের শেষের দিক। সেই সময় যখন দীপকদা (দীপক গাঙ্গুলী)-র সাথে পরিচয়, তখন থেকেই আমরা খুব আকর্ষণীয় একটা স্কেচবুক তৈরির কথা ভাবতে আরম্ভ করেছিলাম যেখানে ভারতের প্রখ্যাত কিছু জাতীয় উদ্যান (National Park) এবং অভয়ারণ্যের (Wildlife Sanctuary) কিছু নামজাদা বাঘেদের ছবিসহ তাদের 'ব্যক্তিগত' জীবনের খুঁটিনাটি সব থাকবে। সে বছরের শেষের দিকে ওঁর পাঠানো একটা টেক্সটের হাত ধরেই আমাদের কানহা সফরের সূত্রপাত ঘটেছিল বলা যায়। পেশাগতভাবে দীপকদা টেকনিকালারের একজন অ্যানিমেটর আর ডিপ নিব ইঙ্ক ড্রয়িংয়ে বাঘেদের স্কেচ আঁকা তাঁর নেশা। যখন উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে 'ব্রেভ হার্টস্ অব ইণ্ডিয়া' শীর্ষক আসন্ন এই বইটির জন্য আমি কিছু বাঘেদের নিয়ে লিখতে আগ্রহী কি না, আমার কাছে হ্যাঁ বলায় দ্বিমত প্রকাশের কোনও জায়গাই ছিলনা। প্রসঙ্গত, এই প্রজেক্টের সাথে যুক্ত ছিলেন আরও দু'জন মানুষ- বন্যপ্রাণ আলোকচিত্রী বালাজী লোগোনাথন এবং চিত্রশিল্পী কিরণ ভাট। ঘটনাচক্রে বই সংক্রান্ত কিছু আলোচনার পর্ব এমনভাবে এসে উপস্থিত হলো যে টেলিফোন কনফারেন্সে আর খুব বেশিদিন সফলভাবে কথাবার্তা এগনো দুরূহ হয়ে পড়লো। অগত্যা, গন্তব্য স্থির হলো কানহা জাতীয় উদ্যান। '১৭-র নভেম্বরে টিকিট কাটা হলো এবং রিসর্ট বুকিং পর্ব সেরে ফেললাম। প্রাথমিক কিছু আলোচনা ও গোছগাছ সেরে অবশেষে এসে উপস্থিত হলো সেই বহু আকাঙ্খিত দিন- ২০১৮-র ১১ জানুয়ারি।

কানহার পথে

  জীবনে কখনও ভাবিনি অরণ্যসফরের সূচনা ঘটবে কানহার মতো এত বিশাল ব্যাপ্তির জাতীয় উদ্যানের বুকে। সুতরাং মনের মধ্যে প্রবল উৎসাহ দানা বাঁধতে লাগলো। কলকাতা থেকে কোনও সফর সঙ্গী না থাকায় সম্পূর্ণ একাই পাড়ি দিলাম। প্রাথমিকভাবে ঝঞ্ঝাট বাধালো আমার বুকিং করা ট্রেন স্বয়ং- সাত ঘন্টা দেরীতে এসে পৌঁছবেন তিনি! টিকিট বাতিল করে গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসের কম্পার্টমেন্ট বুক করলাম। দু'ঘন্টাও সফর শুরু হয়নি, চরম আর এক বিভ্রান্তি- থার্ড ইয়ারের (বি.এ.) পরীক্ষার রুটিন ও ফর্ম ফিল আপের যাবতীয় নোটিশ দেওয়া হয়ে গিয়েছে বলে খবর দিল বন্ধু তন্ময়। এসব শোনার পর রেল সফরের প্রথম দিকটা যে বেশ কিছুটা বিস্বাদের মধ্যে কেটেছিল, একথা বললে অত্যুক্তি হয়না। যাই হোক, রাত্রিযাপন ট্রেনেই। এলো পরের দিনের সকাল। স্টেশন থেকে একে একে সব জিনিসপত্র গাড়িতে তুললাম।  নাগপুর স্টেশনেই সাক্ষাৎ হলো বালাজী স্যারের সাথে। দরাজদিল মানুষ। সহাস্য বদনে এগিয়ে এসে হ্যাণ্ডশেক করে ক্যামেরা কিট্ গাড়িতে তুললেন। ওদিকে ততক্ষণে নাগপুরে এসে গেছেন দীপকদাও। স্টেশনে আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন আরও এক বাঘপাগল অরণ্যপ্রেমী সাগ্নিকদা- সাগ্নিক সেনগুপ্ত। সাগ্নিকদা তখন পেঞ্চ টাইগার রিজার্ভের শাকম্ভরী রিসর্টের সাথে যুক্ত ছিলেন। অবশেষে এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। এসে পৌঁছলেন কিরণ ম্যামও। সাগ্নিকদাকে বার বার অনুরোধ করলাম রাতে কানহায় চলে আসুন। বুঝলাম ইচ্ছুক উনি, কিন্তু স্পষ্টভাবে জানালেননা আসবেন কি না। ফোনে প্রতুত্তরের অপেক্ষায় থেকে আমরা এগোতে থাকলাম। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের গাড়ি যখন মধ্যপ্রদেশের সেওনি জেলার জাতীয় সড়কের ওপর দিয়ে ধাবমান, মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই পেঞ্চ জাতীয় উদ্যানের অবস্থিতির কারণে দীপকদা বায়না জুড়ে বসলেন। এত কাছে এসেও ওইদিনের বিকেলে পেঞ্চে একটা সাফারি বুক করব না- এটা আমরা কেউই ভাবতে পারলামনা। সেখানে তুলি টাইগার করিডোরের কর্ণধার আমাদের অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু ও পরিচিত মানুষ গাইড ওমবীর চৌধুরী। সাদর আমন্ত্রণ জানালেন চৌধুরী সাহেব। পৌঁছনোয় ও সাফারি ব্যবস্থাপনায় কোনও ত্রুটিই হয়নি। তুরিয়া জোনে ইভনিং শিফটে বেরিয়ে আমরা সবাই আশায় ছিলাম পেঞ্চ সম্রাজ্ঞক কলারওয়ালির সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য। ২০০৫ সালে জন্ম হয় বিবিসি-র 'টাইগার- দ্য স্পাই ইন দ্য জাঙ্গল' খ্যাত এই বাঘিনীর। যে এখনও পর্যন্ত আটবারে জন্মগ্রহণ করা সর্বমোট তিরিশটি শাবককে বড়ো করে তুলতে পেরেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কলারওয়ালির দেখা আমরা সে বিকেলে পাইনি। তার পরিবর্তে দেখা হলো তার বোন লঙ্গড়ীর প্রায় দু'বছর বয়সী দুই ছেলের সাথে। গাড়ি পথে দাঁড় করিয়ে ডানদিকের একটি টিলার দিকে দূরবীণে চোখ রেখে দেখতে পেলাম এগিয়ে আসছে দুই প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ- দুই ভাই। একজন একটু বেশিই লাজুক। গাড়ির উপস্থিতি টের পেয়ে সে না এগিয়ে টিলার ওপরের ঝোপের মধ্যে বসে পড়লো। তার ভাই যে এত লাজুকতার ধার ধারেনা সে কিছুক্ষণ বাদেই রাস্তা পেরোনোর পথ না পেয়ে এগিয়ে এসে মৃদু গর্জন করে চার্জ করে বুঝিয়ে দিল। আমাদের গাইড শর্মিলা যাদব বলেছিলেন তুরিয়া গেটের কাছেই এক পুরুষ চিতাবাঘ (Leopard) সকালে চিতল হরিণের (Spotted Deer) ভোজ সেরে কাছাকাছি বিশ্রাম নিচ্ছে। আমরা পথের পাশের গাছগুলোর ওপর নজর রাখছিলাম যদি শিকারের অবশিষ্টাংশ দেখে আমরা শিকারীর দিশা খুঁজে পাই। কিন্তু সবাই আশ্চর্য হলাম যখন মিনিট পাঁচেক ড্রাইভ করার পরেই আমরা ছোপধারী শিকারীকে দেখলাম একটি বড়ো পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছে দেখে। বাঘের চেয়েও চিতাবাঘের দেখা পাওয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য এদের লাজুক স্বভাবের জন্য। সফরের আগে প্রায় সকল বন্ধুবান্ধব বা প্রিয়জনেদের বলতাম যে শুভেচ্ছা জানালে তা যেন চিতাবাঘ দর্শনের সাফল্য কামনা করেই জানানো হয়। সবার শুভেচ্ছা সেদিন সত্যিই সার্থক হয়েছিল। পেঞ্চের বিদায়ী বিকেলের পড়ন্ত রোদে আমরা সাফারি জিপ ছেড়ে যখন নিজেদের গাড়িতে উঠতে যাবো, তখনই সাগ্নিকদার ফোন- "চল, এগোতে থাক। রাতে কানহায় দেখা হচ্ছে।" নির্জন রাস্তায় আমাদের গাড়ির পাশে গাড়ি এনে হাত নেড়ে ইশারা করে যা ভয়টাই দেখিয়েছিলেন সেকথা বলতে আরম্ভ করে এ লেখার কলেবর বাড়াতে চাইনা। সে স্মৃতিচারণা নাহয় কখনও আলাদা প্রসঙ্গে হবে। কনকনে শীতের মধ্যে জবুথবু হয়ে যখন আমরা আমাদের কাঙ্খিত রিসর্ট 'মোটেল চন্দন'-এ পৌঁছলাম, তখন রাত পৌনে এগারোটা প্রায়। মোটামুটি নৈশভোজনপর্ব শেষ করে পরের দিনর প্রাথমিক প্রস্তুতিটুকু সেরেই সোজা ঘুমের দেশে।

"মিনিট পাঁচেক ড্রাইভ করার পরেই আমরা ছোপধারী শিকারীকে দেখলাম"(চিতাবাঘ) 

  ৯৮০ বর্গ কিলোমিটারের কোর জোন এবং ১,৯৪৯ কিলোমিটার বাফার এরিয়া জুড়ে শাল, তেন্দু, বাঁশ, জাম আর পলাশে সাজানো কানহার অন্দর। ১৯৬৫ সালে সরকারিভাবে সংরক্ষিত হওয়ার পর ১৯৭২ সালের বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন বা Wildlife Protect Act অনুসারে এই জাতীয় উদ্যান ১৯৭৩ সালে Project Tiger এর আওতায় আসে এবং ব্যাঘ্র সংরক্ষিত অঞ্চলের (Tiger Reserve) স্বীকৃতি পায়। কানহার শুষ্ক পর্ণমোচী অরণ্যরাজি ছড়িয়ে রয়েছে মধ্যপ্রদেশের মাণ্ডলে এবং বালাঘাট জেলায়। মাঝে বয়ে চলেছে সাদা-কালো হাঁলো ও বানজার নদীর অববাহিকা। জাতীয় উদ্যানের স্বীকৃতি পাওয়ার পরই বিতর্ককে সঙ্গী করে জঙ্গলের ভেতরে ছড়িয়ে থাকা প্রায় তিরিশটি বাইগা ও গোন্দ উপজাতির গ্রাম উচ্ছেদ করে নিয়ে আসা হয় জঙ্গলের বাইরে। ছিন্নমূল হন বহু মানুষ। ঠুঠা বইগা আর বিরজু বইগারা হয়তো তাদের উত্তরপুরুষের মধ্য দিয়ে আজও খুঁজে বেড়ায় তাদের আদিভূমি!


ক্রেস্টেড সার্পেন্ট ঈগল
বারাশিঙ্গা দম্পতি

  ভোর সাড়ে পাঁচটা। আকাশে তখন ঊষার সোনালি ছোঁওয়া। জানুয়ারির হাড়কাঁপানো কনকনে শীতে যথাসম্ভব শীতবস্ত্রে আচ্ছাদিত হয়ে তখন একদিকে অসাড়তা ও অন্যদিকে মনের গভীরে লালিত খুশির মৃদু ঝলকের উষ্ণতা। গাইড প্রেম যাদব ও ড্রাইভার কৈলাশ খেরওয়ারের সাথে বেরিয়ে পড়লাম মুক্কির পথে। আমাদের প্রথম দিনের মর্নিং শিফট্ মুক্কি জোনে। কানহায় আসার আমাদের মূল আকর্ষণ যেহেতু বাঘ, তাই প্রেমজী আর কৈলাশজী অন্যদিকে খুব বেশি দৃষ্টিক্ষেপ না করে মুক্কির এমন একটি অংশে নিয়ে গেলেন, যেখানে কানহার অত্যন্ত পরিচিত মুখ- দাপুটে বাঘিনী ধোয়াঝাণ্ডি ফিমেলকে (KTR T-27) প্রায়ই দেখা যাচ্ছে তার ছ'মাস বয়সী চার শাবকের সাথে। একে হাত-পা ঠাণ্ডায় অবশ, তার ওপর আরও অস্বস্তিকর পরিস্থিতি- প্রবল ঘুমে চোখ প্রায় ঢুলুঢুলু। হঠাৎই জিপসির পাশের জঙ্গলে শোনা গেল দৌড়ঝাঁপ করার আওয়াজ। এবার স্পষ্ট দেখা গেল দুই খুদেকে খেলতে খেলতে, গড়াগড়ি খেতে খেতে নীচের দিকে নেমে আসতে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যেও টান টান উত্তেজনা! বাচ্চারা এখানে মানে মা-ও কাছাকাছিই থাকবে নিশ্চয়ই! এই জন্যই তো মুক্কির এই পথে সকাল সকাল আসা! প্রায় মিনিট পনেরো অপেক্ষা করার পরে এদের কিছুক্ষণের জন্যে নিজেদের মতো ছেড়ে চিতল ও সম্বরদের সুরম্য আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে গেলাম অরণ্যের গহীনে। পথে দেখা এক তরুণ চিতলের সাথে। হরিণ বলতে তার ইংরেজি প্রতিশব্দ 'deer' ও 'antilope'- দু'টি শব্দের কথা মাথায় এলেও প্রজননকালীন ঋতুতে শিংয়ের পুরোনো আবরণ বা velvet খসে গিয়ে নতুন আবরণ তৈরি হয় 'deer' দেরই ভারতে এই গোষ্ঠীর বড়ো সদস্যেরা হলো চিতল, সম্বর আর কানহার গর্ব বারাশিঙ্গা (Hard Ground Barashinga). এদের শিংকে বলা হয় antler. সফর শেষে ফেলে আসা পথের মাঝেই হঠাৎ দেখা শার্দুল সম্রাজ্ঞীর সাথে! ধোয়াঝাণ্ডি ফিমেলের নাম রাখা হয়েছে তার জন্মস্থান ধোয়াঝাণ্ডি ভ্যালির নামানুসারে। বনদপ্তরের নথিতে সে KTR T-27. তার মা সন্তান লালন পালনে অনবদ্য অনবদ্য আর এক বাঘিনী ছোটি মাদি ওরফে বাবাথেঙ্গা ফিমেল (KTR T-31). সাধারণত যে কোনও big cat, প্রায় চার বা সাড়ে চার বছর বয়সে এসেই মাতৃত্বের প্রথম স্বাদ পেলেও ধোয়াঝাণ্ডির বয়স এখন ছ'বছর এবং এই চার সন্তানের কথা আমরা শুনে আসছি, এরা ওর প্রথমবারের সন্তান (First litter of cubs)। জীনসঙ্গী পছন্দের ব্যাপারে যেকোনও স্ত্রী বেড়ালই খুব খুঁতখুতে। ধোয়াঝাণ্ডিকে অপেক্ষা করতে হয় সার্থক ও উপযুক্ত জীবনসঙ্গীর জন্য। অবশেষে জীবনে আসে ছোটা মুন্না (KTR T-29), মুক্কির রাজা। কর্তব্যপরায়ণা মা আমাদের গাড়ির সামনে দৃপ্ত পদচারণার পরই অদৃশ্য হয়ে গেলেন ঝোপের গভীরে। যাওয়ার আগে হেনে গেলেন একমুঠো অবজ্ঞার দৃষ্টি। সত্যিই তো! তার এলাকায় আমরাই অনাহূত অতিথি! জানা গেল কিছুটা দূরেই অল্পবয়সী চিতল হরিণ ভোরে শিকার করে সে শাবকদের নিয়ে আসতে চলেছে ভোজনপর্বে। ঠিক আগের দিন পেঞ্চে আমার প্রথম ব্যাঘ্রদর্শন ঘটলেও কানহায় এসেই বাঘের দেখা সার্থকভাবে পেলাম। আমার দেখা প্রথম বাঘিনী সে!


সম্বরের পিঠে শালিক

শিং বাহার

  বিকেলের সাফারিতে আমাদের গাইড মল্লু সিং যাদব। চৌখস এবং অভিজ্ঞ। জঙ্গল তাঁর নখদর্পণে। এবার আমাদের সাফারি কানহা জোনে (মুক্কি, কিসলী, সারহি আর কানহার মধ্যে কানহাই হলো প্রাইম জোন)। স্বাগত জানালো জাঙ্গল্ আউলেট নামের ছোটো এক প্রজাতির পেঁচা। সঙ্গে বার্কিং ডিয়ারের কর্কশ অ্যালার্ম কল। বাঘ নেই তো কাছাকাছি? সতর্ক দৃষ্টি হানলাম। বিদ্যুতের বেগে আমাদের গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পার করলো এক চিতাবাঘিনী। তিন শাবকের মা। না, এবার আর খুব ভালো দর্শনলাভ করলাম না আমরা। সফরসঙ্গী সাগ্নিকদার কাছে দুপুরে রিসর্টে শুনেছিলাম তাঁরা যখন সকালে কানহা জোনে ছিলেন, পথের পাশেই একটি গাউরের (বা ইণ্ডিয়ান বাইসন) মৃতদেহ দেখেছিলেন। জেনেছিলাম যে এই পূর্ণবয়স্ক পুরুষ গাউরটিকে আগের দিন শিকার করেছিল বিশালবপু বাঘ বজরঙ্গ (KTR T-64). এবারে আমরা শিকারে মৃতদেহ (ও সেইসঙ্গে শেয়াল ও বুনোশুয়োরের সেই মৃতদেহ সৎকার) দেখলেও শিকারির হদিশ পেলামনা। অন্য একটি জিপসির গাইডের মারফৎ খবর পেলাম মহারাজ বজরঙ্গ কাছাকাছি অবস্থান না করলেও তার সঙ্গিনী নয়না (ওরফে লিঙ্ক-৮ ফিমেল বা KTR T-75) খুব কাছেই টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। মংলু তিরাহ্ নামের মিডোসে পৌঁছে আমরা লক্ষ্য করতে থাকলাম কাছাকাছি কোনও সংকেত পাই কি না। জিপসির ডানদিকে গুটিকয়েক চিতল হরিণ। বাঁ দিকে বারাশিঙ্গার ছোটো একটি দল। কেউ তো তটস্থ নয়! সবাই যে যার মতো তৃণভোজে ব্যস্ত। ইতিমধ্যেই দূরবীণে চোখ রেখে ঘাসের জঙ্গলের একটি প্রান্তে আঙ্গুল দেখিয়ে মল্লু সিং যাদবের আত্মবিশ্বাসী ঘোষণা- "কৈলাশ, গাড়ি রোখ! ইধার সে নিকলেগি!" অ্যাড্রেনালিন ফ্লো চরমে উঠেছে ততক্ষণে! এই কি তবে বাঘ আসার আগের প্রিলিউড? নিস্তব্ধতা, রহস্যময়তা, রোমাঞ্চ আর সাথে মেশানো ভয়! অবশেষে চিতলের সন্দিহান সাবধানবাণী! প্রায় এক কিলোমিটারের অর্ধেক দূরত্বে দেখা গেল মহারানীকে। সন্দিগ্ধ ও ভীত সন্ত্রস্ত চিতলের সারিকে উপেক্ষা চরে নয়না আমাদের গাড়ির সামনে রাস্তা পেরিয়ে অপর প্রান্তে এলো। জন্ম ২০১৩ সালের জুলাই-আগস্টের দিকে। মা লিঙ্ক-৭ ফিমেল। নয়নার এক যমজ ভাইও ছিল। কিন্তু জন্মের কয়েক সপ্তাহ পরে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। হয়তো অন্য কোনও পুরুষ বাঘ অথবা চিতাবাঘ তার হত্যার জন্য দায়ী। আট নম্বর রুটে প্রথম সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়েছিল বলে তার নাম লিঙ্ক-৮ ফিমেল। ধোয়াঝাণ্ডি ফিমেলের মতো সেও প্রথমবার মা হয়েছে সম্প্রতি। আমাদের দুর্ভাগ্য, তার তিনমাস বয়সী শাবকদের দেখা আমরা পাইনি। বাঘ ও বেড়াল গোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যেরা নিজের এলাকায় 'সেন্ট মার্কিং' করে (প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ড. রতনলাল ব্রহ্মচারী scent marking এর খুব জুতসই একটি বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করতেন- 'ঊর্ধ্বমূত্রক্ষেপণ', আদর করে 'পিচকারি মারা') ও গন্ধ শুঁকে নিজের এলাকার নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে। নিজের অন্দরের সবকিছু ঠিকঠিক আছে কি না তা যাচাই করে নয়না আবার যখন রাস্তার ওপর আসতে যাবে, তখন প্রায় দু'শো মিটারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রস্ত বারাশিঙ্গার দল অ্যালার্ম কল শুরু করলো। একই ক্লিপিংয়ে বাঘ, চিতল হরিণ ও বারাশিঙ্গাকে লেন্সবন্দী করে তখন উৎসাহ ও আনন্দে দিশেহারা হওয়া থেকে কোনওরকমে নিজেকে সামলে রেখেছি। মৃদু গর্জন করে নিজের বিরক্তির জানান দিয়ে নয়না এগিয়ে চললো তার অন্দরের অপর প্রান্তের টহলদারীতে। বিদায় জানাতে কারই বা ইচ্ছে করে? কিন্তু জানাতেই হয়। নীলাঞ্জন জেঠু (নীলাঞ্জন রায়চৌধুরী)-র কথায় বলতে গেলে তাঁর ২০১২-র একটি আন্তরিক লেখা 'শিবাজী মহারাজ- তাডোবা আর আমি'-র প্রসঙ্গ এনে কয়েকটি হৃদয় ছোঁওয়া কথা বলতেই হয়, যেগুলি ছাড়া বোধ হয় এই মুহূর্তকে শব্দে বাঁধা অসম্ভব। ভালোবাসাকে গৃহপালিত করে রাখা যায়না। সেটা তো ভালোবাসার একটা দিক মাত্র। সত্যিকারের ভালোবাসা আকাশের মতোই উদার এবং অরণ্যের মতোই গভীর ও সংবেদনশীল। নয়নার দর্শন তাই আমাদের আরণ্যক উপহার হলেও তাকে আমরা আটকে রাখতে তো পারিনা! জানিনা, আবার কবে তার দেখা পাবো? বারাশিঙ্গার তীব্র সাবধানবাণী আর ময়ূরের কেকাধ্বনি তখন দূরে মুখরিত হয়ে চলেছে।


নয়না

  সংবিৎ ফিরল। না, বারাশিঙ্গার অ্যালার্ম কলে নয়। ফোনের অ্যালার্মে! স্বপ্নেই বিভোর হয়ে ছিলাম বটে! তবে স্মৃতি আজও অমলিন। পরের দু'টো দিন কানহায় বারাশিঙ্গাদের দলের সাথে এবং শেষ দিন অন্যতম প্রভাবশালী বাঘ কড়াইঘাটি মেলকে (KTR T-2) দেখে বেশ জমজমাট কেটেছিল বটে! স্মৃতির মণিকোঠায় থেকে যাবে শেষদিনর কিসলী ওয়ারহোলের সূর্যাস্তে 'কাজলনয়না হরিণী'দের সমাগম (যতদূর মনে আছে অন্তত ওখানে কোনও পুরুষ হরিণ তখন ছিলনা, ছবিও সেই কথাই বলে)। মনে রয়ে যাবে কিসলী গেস্ট হাউসে পড়ন্ত বিকেলে কানহার ফিল্ড ডিরেক্টর ড. সঞ্জয় শুক্লার সাথে বসে 'ব্রেভ হার্টস্ অব ইণ্ডিয়া'-র ডেমনস্ট্রেশন দেওয়া ও আলোচনা। ১৫ জানুয়ারি ছিল দীপকদার জন্মদিন। উনি বার বার বলছিলেন, "মেল টাইগার তো হলো, একটা যদি গাউরের দেখা পেতাম!" সন্ধ্যের মুখেই আমাদের চায়ের আসরে এসে দূরে উপস্থিতি জানান দিল এক পুরুষ গাউর। জন্মদিনের সেরা উপহার দীপকদার জন্য। বন্দিদশায় আজ বড্ড মনে পড়ছে আরণ্যকদের কথা, আরণ্যক হৃদয়ের কথা। আমরা কবে আবার মুক্ত হ'ব জানা নেই। আবার কবে দেখতে পাবো তোমাদের? আরও কিছুটা সময় তো কাটবেই বন্দিদশায় তারপরের নতুন সূর্যে স্নাত কোনও এক সকালে শিশিরভেজা ঘাসের বনে আবার যদি দেখা হয়, কেমন হবে বলোতো? আবারও ময়ূরেরা জানান দেবে নয়নার দৃপ্ত চলাফেরার নীরব শব্দকে। শীতের পড়ন্ত বিকেলে চোখ খুঁজবে কোনও গাছে ডালে অলস চিতাবাঘ বিশ্রাম নিচ্ছে কি না। দেখা কখন পাবো, তা জানা নেই। কিন্তু, আর সত্যিই যে পেরে উঠছিনা তোমাদের সান্নিধ্যে না গিয়ে? যখন হঠাৎ আবার ওই গহনে দু'জনের দেখা হবে, তৃষিত হৃদয়কে চিনতে পারবে তো? রইলাম প্রতীক্ষায়...
সোনালী ঊষার ছোঁওয়ায়







ছবিগুলো তুলেছেন লেখক নিজেই।

© 2020 প্রতীক মহাপাত্র





1 টি মন্তব্য: